শীতকালে খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা ও অপকারিতা জেনে নিন

শীতের হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় অনেকেই কাঁচা খেজুরের রস পান করতে পছন্দ করেন। কেউ কেউ এই রস প্রক্রিয়াজাত করে পিঠা-পুলি, পিঠা, গুড় তৈরি করে খায়। সারা বছরই খেজুরের রস সংগ্রহ করা যায়। তবে শীতের খেজুরের রস বেশি সুস্বাদু। শীত শুরু হলে রসের পরিমাণ ও গুণমানও কমে যায়।

শীতকালে খেজুরের রস

খেজুরের রস খনিজ ও পুষ্টিগুণে ভরপুর। বাংলাদেশে জন্মানো খেজুরের পর্যাপ্ত শাঁস নেই তাই অনেকেই এগুলো খেতে পছন্দ করেন না। তাই খেজুরের রসই আসল আকর্ষণ। খেজুরের রস থেকে তৈরি গুড় অনিদ্রা ও কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেজুর গুড় লৌহ সমৃদ্ধ এবং হিমোগ্লোবিন গঠনে সাহায্য করে। শারীরিক দুর্বলতা দূর করতে এবং প্রেরণা ফিরিয়ে আনতে খেজুরের রস খুবই উপকারী।

খেজুরের রসের উপকারিতা

জুসের উপকারিতা জানলে এখন থেকে প্রতি শীতে প্রতিদিন নিয়মিত এক গ্লাস জুস খাবেন। তো চলুন শুরু করা যাক খেজুরের রসের উপকারিতার দিক থেকে:

প্রকৃতির এনার্জি ড্রিংকস খেজুরের রস

খেজুরের রসে সাধারণ শর্করা বা ফ্রুক্টোজ এবং প্রায় 15-20% গ্লুকোজ থাকে। এই মিশ্রিত শর্করাতে প্রচুর পরিমাণে খনিজ লবণ ও খনিজ পদার্থ থাকে। অনেক উপকারী উপাদান একত্রে সর্বোত্তম অনুপাতে মেশানো হয় যা এটিকে যেকোনো কৃত্রিম এনার্জি ড্রিংকের চেয়ে ভালো এবং স্বাস্থ্যকর করে তোলে। এক গ্লাস খেজুরের রস তাৎক্ষণিক শক্তি দেয়। রসে থাকা গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ দ্রুত রক্তে শোষিত হয় এবং শক্তির অভাব দূর করে।

খেজুরের রস রক্তস্বল্পতা দূর করে

রসে লোহা বা আয়রন সুপ্ত থাকে। গুড় বা লালি তৈরি করতে রস পুড়িয়ে দিলে তাতে প্রচুর আয়রন থাকে। রক্তশূন্যতা দূর করতে প্রতিদিন এক টুকরো গুড় বা এক চামচ লালি খেতে হবে। খেজুরের গুড় পিঠা খাওয়া বাংলাদেশে খুবই সাধারণ তাই এই শীতে বিপুল জনসংখ্যার প্রায় ১/৫ জন রক্তস্বল্পতা থেকে রক্ষা পায়।

পেশী মজবুত করে

পটাসিয়াম এবং সোডিয়াম পেশীর স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে খুবই কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। খেজুরের রসে প্রচুর পরিমাণে পটাশিয়াম ও সোডিয়াম থাকে তাই রস বা গুড় মাংসপেশিকে শক্তিশালী করে। এটি পেশীর দৃঢ়তা দূর করতেও কাজ করে। স্নায়ু কোষগুলি নিউরন নামক সংযোগস্থলে একে অপরের সাথে সংযুক্ত থাকে। মানসিক সংকেত এই স্থান দিয়ে ভ্রমণ করে। পটাসিয়াম এবং সোডিয়াম স্নায়ু সংকেত সংক্রমণে একটি প্রধান ভূমিকা পালন করে।

ক্লান্তি দূর করে

ম্যাগনেসিয়ামের অভাব আমাদের অলস বা ক্লান্ত বোধ করে। রসে প্রচুর পরিমাণে ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। এটি পান করলে ক্লান্তি দূর হয় এবং শরীরের প্রাণশক্তি ফিরিয়ে আনে।

হাড় মজবুত করে

খেজুরের রসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল ক্যালসিয়াম। এটি হাড় এবং পেশী গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। খেজুরের রস হাড়ের প্রধান উপাদান ক্যালসিয়ামের অভাব দূর করে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়

রসে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। শরীর থেকে ক্ষতিকারক পদার্থ বের করে দেয়।

ভিটামিনের অভাব দূর করে

রসে রয়েছে ভিটামিন বি-৩। এটি রক্ত উৎপাদন এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। ভিটামিন সি কোষ থেকে বর্জ্য পদার্থ অপসারণ করে। ঠান্ডা থেকে বাঁচায়।

ওজন কমাতে সাহায্য করে

রসের মিষ্টি স্বাদ অপরিশোধিত চিনির কারণে। এটি ধীরে ধীরে রক্তে শোষিত হয় যার ফলে শরীরে চর্বি কম জমা হয়। কিন্তু নিয়মিত চিনি দ্রুত রক্তে প্রবেশ করে তাই খেজুরের রস হতে পারে চিনির খুব ভালো বিকল্প। রসে পর্যাপ্ত পটাশিয়াম থাকায় এটি বিপাকীয় ক্ষমতা বাড়ায়, ফলে শরীরে অতিরিক্ত চর্বি কম জমে এবং ওজন নিয়ন্ত্রণে থাকে।

কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে

রসে প্রচুর পরিমাণে ফাইবার থাকে। এটি মলের পরিমাণ বাড়ায় এবং মলকে নরম করে তাই রস কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে কার্যকর ভূমিকা পালন করে। খেজুরের গুড়ও তাই করে। এটি অনিদ্রা দূর করতেও সাহায্য করে।

হজমশক্তি বাড়ায়

রস আমাদের হজমের সাথে জড়িত এনজাইমের নিঃসরণ এবং কার্যকলাপ বাড়ায়, ফলে খাবার দ্রুত হজম হয়। খাবারের পর অল্প পরিমাণ রস বা গুড় খেলে হজম প্রক্রিয়া দ্রুত হবে।

খেজুরের রসের অসুবিধা

খেজুরের রসের অনেক উপকারিতা সম্পর্কে জানলে এখন জেনে নিন এর অপকারিতা সম্পর্কে।ডায়াবেটিস রোগীদের খেজুরের রস খাওয়া উচিত নয় কারণ এতে থাকা চিনি ডায়াবেটিসের সমস্যা বাড়িয়ে দিতে পারে। খেজুরের রস পান করলে কিডনি রোগীদের সমস্যা হতে পারে। রসে থাকা পটাশিয়াম কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে। রক্তের সমস্যায় আক্রান্ত রোগীদের জুস খাওয়া উচিত নয়।হাঁপানি বা হাঁপানি রোগীদের ঠান্ডা রস পান করা উচিত নয় কারণ এটি শ্বাসকষ্ট বাড়িয়ে তুলতে পারে।

বাদুড়রা রসের পাত্র থেকে রস পান করে এবং বাদুড়ের মুখ থেকে রস পান করে বিভিন্ন রোগের জীবাণু ছড়ায়। কখন খাবেন, কখন খাবেন না: সকাল সকাল খেজুরের রস খাওয়া ভালো। সারারাত রস জমে থাকার পর সকালে এই জুস পান করলে উপকার পাওয়া যায়। যাইহোক, সময়ের সাথে সাথে গাঁজন সঞ্চালিত হয়।

এটি রসের স্বাদ নষ্ট করে এবং অ্যাসিডিটি বাড়ায়। অন্ধকারে এই প্রক্রিয়াটি ধীর, কিন্তু দিনের আলোতে গাঁজন বেশি হয়। তাই দিনে জুস খাওয়া ঠিক নয়। এতে বমিসহ পেটের সমস্যা হতে পারে। খেজুরের রসে যেন কোনো পোকামাকড় না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাদুড় বা পাখির মুখের রস খেলে রোগ হতে পারে।

কতটা জুস পান করবেন

 একজন সুস্থ মানুষ সকালে এক থেকে দুই গ্লাস জুস পান করতে পারেন। সকালে খালি পেটে খেলে কোনো সমস্যা নেই। যেহেতু এটি একটি এনার্জি ড্রিংক, তাই শরীরে শক্তি জোগাতে পরিমাণমতো রস খাওয়াই ভালো।

যেভাবে খাবেন

রাতে বা সকালে জুস খেতে পারেন বা জুস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন খাবার খেতে পারেন। তবে খোলা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা হয় বলে এতে জীবাণু থাকতে পারে। এটা অস্বাস্থ্যকর। এ কারণে হালকা আঁচে বা ফুটিয়ে রস সেবন করা ভালো। এ ছাড়া জুস জ্বালিয়ে বিভিন্ন খাবার তৈরি করতে পারেন।

খেজুরের রস খাওয়ার আগে কিছু সতর্কতা

সূর্যের তাপ ওঠার আগে এই জুসটি খুব ভোরে খাওয়া উচিত। ছত্রাক বাতাসে ভেসে থাকে এবং রসের সাথে মিশে যায় এবং সূর্যের তাপে উত্তপ্ত রসকে গাঁজন করে প্রথমে অ্যালকোহল বা ওয়াইন তৈরি করে এবং তারপরে ভিনেগারে গাঁজন করে। এ ধরনের জুস পান করলে পেট খারাপ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

 রসের পাত্র যেন নেট বা কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখা হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। বাদুড় পাত্রের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে রস খায়। এ থেকে নিপাহ ভাইরাস সংক্রমণের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই খেজুরের রস সিদ্ধ করা নিরাপদ। অবশেষে শীতকাল এ সময় গাছিরা খেজুর গাছ থেকে খেজুরের রস আহরণে ব্যস্ত।

তারা খেজুরের রস থেকে গুড় তৈরি করে জীবিকা নির্বাহ করে। অনেকে খেজুরের গুড় তৈরি করে এবং খেজুরের রসও বিক্রি করে কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে এই খেজুরের রসের মারাত্মক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। গাছিরা বিকেলে খেজুর গাছে মাটির হাঁড়ি বসিয়ে আসে। মাটির হাঁড়ি সর্বত্র খোলা। 

রাতে বাদুড় এসে সেই খোলা খেজুরের রসের পাত্রে বসে রস পান করে। তারপর বাদুড়ের মুখ থেকে লালা মিশে যায় রসের সঙ্গে। আর এভাবেই নিপাহ ভাইরাস বাদুড়ের মাধ্যমে মানুষের শরীরে আক্রমণ করে। নিপাহ ভাইরাস একটি প্রাণঘাতী ভাইরাস। 

কেউ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হলে প্রথমেই জ্বর আসে। খিঁচুনি, পরে মৃত্যু ঘটতে পারে। যেহেতু খেজুরের রস পান করলে এ রোগ হয় তাই খেজুরের রস আহরণে সতর্ক থাকতে হবে। আসুন আমরা স্বাস্থ্য সচেতন হই সতর্কতা অবলম্বন করি।

শেষ কথা 

আপনারা যারা শীতকালে খেজুরের রস পানের উপকারিতা নিয়ে আজকের পোস্ট পড়েছেন তাদের প্রতি আমাদের পূর্ণ মনোযোগ রয়েছে। শীতে খেজুরের রস খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে তারা নিশ্চয়ই সঠিক তথ্য জেনেছেন। শীতকালে গ্রামের বাঙালিদের কাছে খেজুরের রস একটি প্রিয় খাবার হিসেবে বিবেচিত হয়। খেজুরের রস দিয়ে শীতে বিভিন্ন পিঠাপুলিও তৈরি করা হয়। শীতে খেজুরের রস খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। তাই আসুন শীতে নিয়মিত খেজুরের রস খাই এবং সুস্থ থাকি। (২০১)

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

বন্ধুমহল আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url